একটি মুমূর্ষু শহরের জন্য প্রার্থনা
আবদুল মান্নান লিখেছেন কালেরকন্ঠে
|
![]() বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই বুঝতে পারবে না একদা কেমন ছিল বাংলাদেশের এই বাণিজ্যিক রাজধানী। বাংলাদেশের এটি একমাত্র জেলা অথবা শহর, যেখানে নদী, সমুদ্র, পাহাড় আর সমতলভূমি আছে বা ছিল। জলাবদ্ধতা কী, তা এ শহরের মানুষ জানতই না। কারণ শহরের পানি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ার জন্য শহরের উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্ব-পশ্চিমে একাধিক খাল ন্যূনতম ৩০ থেকে ৪০ ফুট প্রশস্ত ছিল, যার অন্যতম চাক্তাই খাল। আমার নানাবাড়ি ছিল চাক্তাই খালের পাড়ে। সেই খালে আকিয়াব আর রেঙ্গুন থেকে লবণ, চাল আর কাঠবোঝাই বড় বড় গয়নার নৌকা এসে নোঙর ফেলত। চট্টগ্রামের দখলবাজরা সেই খাল বহু আগেই দখল করে ফেলেছে। দখলের রাজনীতিতে সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের এক অপূর্ব ঐকমত্য আছে। চট্টগ্রামে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যে পাহাড়গুলো ছিল, সেগুলো এখন আর নেই। কারণ বিত্তবানদের জন্য হাউজিং আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বানাতে হলে এসব পাহাড় কাটতেই হবে। সেই কাটা পাহাড়ের মাটি একটু বৃষ্টি হলেই পানির সঙ্গে মিশে নালা-নর্দমায় এসে জমা হয়, পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়। এ দখলদাররাই পরবর্তী সময়ে জলাবদ্ধতা নিয়ে মেয়রদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে। একসময় পলিথিন ব্যাগ বন্ধ করতে সরকার কিছুটা হলেও সফল হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকার তার সেই সফলতা ধরে রাখতে পারেনি। কাঁচাবাজারে গেলে আড়াই শ গ্রাম তরকারি নিলে দোকানদার না চাইতেই তা একটি পলিথিন ব্যাগে ভরে দেয়। ভারতের যেকোনো শহরেই একটি পলিথিন বা যেকোনো ধরনের শপিং ব্যাগের দাম ন্যূনতম পাঁচ রুপি। কিছুদিন আগে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বইয়ের দোকান থেকে প্রায় সাত হাজার রুপির বই কিনেও দুটি পলিথিনের শপিং ব্যাগ কিনতে হয়েছে ১০ রুপি দিয়ে। কলকাতার মানুষ এখন সকালে বাজারে যাওয়ার সময় কাপড় বা চটের ব্যাগ নিয়ে যায়। এ রেওয়াজটা আমাদের দেশেও একসময় চালু ছিল। বাংলাদেশে ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরে এসব পলিথিন ব্যাগের শেষ গন্তব্য নালা-নর্দমায়। এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে আমরা শহুরে অনেক মানুষ এখনো ডাস্টবিন ও নালা-নর্দমার মধ্যে পার্থক্য বুঝি না। চট্টগ্রামের মেয়র নিখরচায় করপোরেশনের লোকদের দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিনের আবর্জনা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছেন। তার জন্য প্রতিটি বাড়িতে একটি করে প্লাস্টিকের বাস্কেটও বিনা খরচায় দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষ বাক্সটি অন্য কাজে ব্যবহার করে বাড়ির আবর্জনা সেই নর্দমায়ই ফেলছে। জলাবদ্ধতা তো হবেই। চট্টগ্রামের মতো এত অপরিকল্পিত শহর এই অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। নর্দমার ওপর মার্কেট, দোকানপাট, লোহালক্কড় অন্য কোনো শহরে দেখা যায় না। মার্কেট আর দোকানপাটগুলো বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে হয়েছে। একসময় চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ক্রিকেট আর ফুটবলের জমজমাট আসর বসত। স্টেডিয়ামের বাইরে চারটি খেলার মাঠ ছিল, যেখানে আমার শৈশব কেটেছে। বর্তমানে আর কোনো খেলার মাঠ অবশিষ্ট নেই। পুরনো সার্কিট হাউসের পূর্ব দিকে নতুন সার্কিট হাউস নির্মাণ করে প্রথম খেলার মাঠটির মৃত্যু ঘটানো হয়। এরপর এক মেয়র এসে তার পাশে একটি শিশু পার্ক নির্মাণ করে দ্বিতীয় মাঠ ও অপূর্ব এক খোলা মাঠের কবর রচনা করেন। পূর্ব দিকে ছিল আউটার স্টেডিয়াম। সেখানে বসত স্টার সামার ক্রিকেট। নান্নু, নোবেল, আকরাম, তামিম, নাফিসসহ অনেকেই এ মাঠে খেলে জাতীয় দলে খেলেছেন এবং কেউ কেউ এখনো খেলছেন। ১৯৯১ সাল থেকে এ মাঠে বছরে একবার বিজয় মেলা বসত। ১৯৮৯ সালে প্রথমটি বসেছিল বর্তমান শিশু পার্কের জায়গায়। এখন সারা বছর সেখানে নানা কিসিমের মেলা হয়। খেলা আর হয় না। চট্টগ্রাম ক্লাব-সংলগ্ন মাঠটিতে রাতারাতি উঠে গেল একটি তারকা খচিত হোটেল। আর এসব কিছুকে কেন্দ্র করে পুরো স্টেডিয়ামপাড়াটি হয়ে গেল রেস্টুরেন্টপাড়া। সব কিছু একসঙ্গে করলে মনে হবে এটি কোনো একটি গঞ্জ। একই অবস্থা আন্দরকিল্লা, নিউ মার্কেট এলাকা, স্টেশন রোড, চকবাজার আর টেরিবাজার এলাকার। এমন একটা জঞ্জালপূর্ণ শহরে জলাবদ্ধতা হওয়া তো অনিবার্য। চট্টগ্রামের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বিশেষ মমত্ব আছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের এক ঘোর দুর্দিনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর এক ঘরোয়া পরিবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে ড. ওয়াজেদ মিয়ার বিয়ে হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবে তাঁদের বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। শেখ হাসিনা যখনই চট্টগ্রামের কোনো সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করেন তিনি তাঁর জীবনের এই স্মৃতির কথা বলতে ভোলেন না। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তিনি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের এক বিশাল জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, এ শহরের উন্নয়নের দায়িত্ব তিনি নিজ হাতে তুলে নিচ্ছেন। উন্নয়ন বরাদ্দ দিতে তিনি কার্পণ্য করেননি। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে অযোগ্য লোকজন পদায়িত থাকার কারণে তাঁর এসব প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়েছে। শহরের দুটি পরিষেবার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। প্রথমটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আর দ্বিতীয়টি ওয়াসা। বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ উত্পাদনে রেকর্ড গড়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময় তা চট্টগ্রামবাসী উপলব্ধি করতে পারে না। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের সময় শহরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিদ্যুৎ থাকে না এবং এর ফলে মানুষ যে সরকারের ওপর বিরক্ত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওয়াসার অবস্থা চার দশক আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে; যদিও এরই মধ্যে মোহরায় একটি বড় ধরনের পানি শোধনাগারের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসবের ওপর আছে শহরের দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের কৃতকর্ম। চট্টগ্রাম শহরের সমস্যা দূর করা কোনো একজন মেয়রের পক্ষে সম্ভব নয়, যদি না এ শহরের সাধারণ নাগরিকরা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হয়। শুরুটা হোক চাক্তাই খাল পুনরুদ্ধার দিয়ে। এটি করা সম্ভব হলে তখন বোঝা যাবে এ শহরের বাঁচার একটা সম্ভাবনা আছে। না হলে বলতে হবে একদা এখানে একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল, যা এ শহরের সব বাসিন্দা মিলে হত্যা করেছে। আসুন, সবাই মিলে শহরটির জন্য দোয়া করি। লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক |